পর্ব -১১
✍️ পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
🌺
সূরা আল বাকারা (আয়াত ৫৬-৬০)
৫৬. অনন্তর তোমাদের জীবিত করলাম তোমাদের মৃত্যুর পর, যাতে তোমরা শোকর করবে।
৫৭. আর ছায়া স্বরূপ করলাম তোমাদের ওপর মেঘকে এবং পাঠালাম তোমাদের নিকট মান্না ও সালওয়া; তোমরা খাও, তার উৎকৃষ্ট বস্তুর সমূহ হতে যা কিছু আমি তোমাদেরকে দান করেছি; আর তারা আমার কোন অনিষ্ট করেনি পরন্ত নিজেদেরই অনিষ্ট করছিল।
৫৮. আর যখন আমি বললাম, প্রবেশ করো এই জনপদে অতঃপর খেতে থাক তা হতে সচ্ছন্দে যেখানে তোমাদের ইচ্ছে হয় এবং দ্বারদেশে প্রবেশ কর নতশিরে আর বলতে থাক, "তওবা" আমি মাফ করে দিব তোমাদের ভুল ভ্রান্তি সমূহ এবং অতিসত্বরই তদতিরিক্ত আরও দান করব আন্তরিকতার সাথে নেক আমল কারীদেরকে।
৫৯. অনন্তর পরিবর্তন করলেই জালেমরা তাদের প্রতি আদিষ্ট শব্দটি তার বিপরীত অপর একটি শব্দ দ্বারা, অতএব আমি নাযিল করেছি সে জালেমদের প্রতি এক আসমানী বিপদ, এজন্য যে, তারা হুকুম অমান্য করছিল।
৬০. আর যখন মূসা পানি প্রার্থনা করল নিজ কওমের জন্য, তখন আমি বললাম, আঘাত করো তোমার লাঠি দ্বারা অমুক পাথরটিকে; তখনই বের হলো তা থেকে বারটি প্রস্রবণ ; প্রত্যেকে জেনে নিল নিজ নিজ পান করার স্থান; খাও এবং পান করো আল্লাহর রিজিক হতে এবং সীমালংঘন করো না দুনিয়াতে ফ্যাসাদ করে।
🌍 আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন।
-----উপরিউক্ত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা----
৫৬.আয়াতের ব্যাখ্যা,
এই উক্তিটির সরলার্থ হচ্ছে, আমি তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করেছি, এখানে মাউত শব্দ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তারা বজ্রপাতের ফলে মৃত্যুবরণ করেছিল। পুনরায় জীবিত করার ঘটনায় এই যে, বনি ইসরাইলের প্রেরিত ৭০ জন প্রতিনিধিরা বজ্রপাতে মৃত্যু বরণ করার পর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে আবেদন করলেন যে,"হে আল্লাহ" আমার জাতি এমনিতে আমার প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে আসছে। এখন তো তারা বলবে যে, আমি তাদের প্রতিনিধিদেরকে কোথাও নিয়ে কোনো উপায়ে ধ্বংস করে দিয়েছি সুতরাং আমাকে তাদের এই অপবাদ হতে পরিত্রান প্রদান করুন। আল্লাহ তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে তাদের এক এককে অপরের সামনে জীবিত করে দিলেন।
বজ্রপাতের কারন:
বনি ইসরাইলের প্রতিনিধিদল যখন হযরত মূসা আলাইহিস সাল্লাম কে বলেছিল, আমরা আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে দেখাবে ব্যাতিত আপনারা আনীত এ কিতাব কে বিশ্বাস করতে পারিনা । অথচ আল্লাহ কে প্রত্যক্ষ দেখা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। অন্যদিকে মুজেজা প্রদর্শনের পর বিশ্বাস করা ফরজ হয়ে গিয়েছিল। তাদের এ দৃষ্টতা ও হঠকারিতার কারণে আল্লাহ তাআলা আকাশ হতে অবতারিত অগ্নিবান অথবা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ভয়ঙ্কর হুংকার দ্বারা তাদেরকে সাময়িকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।
৬৭.আয়াতের ব্যাখ্যা;
এ আয়াতটি দ্বারা তীহ প্রান্তরের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, বনি ইসরাইলের আদিবাস ছিল শাম, বর্তমান সিরিয়া অঞ্চল। এ সময় আমালেকা নামক এক শক্তিশালী জাতি লাম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে। ফেরাউনের থেকে মুক্তি দানের পর আল্লাহ তা'আলা বনী-ইসরাঈলকে তাদের আদি নিবাস পবিত্র ভূমি নামকে আমালেকাদের আধিপত্য থেকে মুক্ত করার আদেশ প্রদান করেন। এ উদ্দেশ্যে তারা সামনের দিকে যাত্রা করে। পথিমধ্যে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা যখন শামের উপকণ্ঠে পৌঁছে, তখন ১২জন প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা আমালেকা সম্প্রদায়ের শৌর্য বীর্য ও বীরত্বের কথা শ্রবণ করে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং জিহাদে অংশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করত হযরত মুসা আলাইস সালাম কে লক্ষ্য করে বলে, তুমি এবং তোমার প্রভু গিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ কর। আমরা এখানে অবস্থান করছি। আল্লাহ তাআলা তাদের এ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে তীহ প্রান্তরে সুদীর্ঘ ৪০ বৎসর আত্নভোলা ও দিকভ্রান্ত অবস্থায় অতিবাহিত করার শাস্তি নাযিল করেন। তাদের সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। এপ্রান্তরে তাদের বিশোরদ্ধ বয়সের সমস্ত লোক ইন্তেকাল করেন। হযরত মুসা এবং হারুন আলাইহিস সালাম ও এখানেই ইন্তেকাল করেন। সেখানে কোন ছায়া ছিল না। ফলে মেঘমালার দ্বারা আল্লাহ তাদেরকে ছায়া দান করেছিলেন ।
..মান্না ও সালওয়া..
হযরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন যে, মান্না তাদের ঘরের ওপর বরফের নেয় পতিত হত যা ছিল দুধের চেয়ে শুভ্র মধুর চেয়ে মিষ্টি। ভোর থেকে শুরু করে সূর্যোদয় পর্যন্ত তা নাযিল হত। প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রয়োজনানুযায়ী আহরণ করত। আব্দুর রহমান ইবনে আসলাম বলেন, মান্না হল মধু। মূলত মুফাসসিরীন দের বক্তব্যেনুযায়ী বলা যায় যে, কারো মতে মান্না এক প্রকার খাদ্য, কারো মতে পানীয়, তবে এটা এমন এক ঐশি নিয়ামত যা বিনা কষ্টে পাওয়া যেত। পানি ছাড়া ভক্ষণ করলে হতো খাদ্য, আর পানি মিশ্রিত করলে হতো পানীয়(ইবনে কাছীর)
সালওয়া,হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, এটা এক প্রকার পাখি যা তারা ভক্ষণ করত। হযরত কাতাদা বলেন, লাল রঙের পাখি। দক্ষিণা বাতাস গুলোকে এনে তাদের কাছে একত্রিত করত। প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রয়োজন মতো তা জবাই করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতো, প্রয়োজনের বেশি নিতে চাইলে বিপর্যয় সৃষ্টি হতো। ইমাম সুদ্দী বলেন, বনি ইসরাইল যখন তীহ প্রান্তরে গিয়েছিল তখন তারা মুসা আলাইহিস সালাম কে বলেছিল, এখানে আল্লাহ তাআলা মান্না অবর্তীর্ণ করেন, যা আদা গাছের ওপর পড়তো। আর সালওয়া যা ছিল পাখির ন্যায় তারা উক্ত পাখি থেকে মোটা গুলো জবাই করতো।
৬০.আয়াতের ব্যাখ্যা,
উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম নিজ সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে পানির জন্য দোয়া করলে আল্লাহপাক পানির ব্যবস্থা করে দিলেন। পাথরের উপর লাঠির আঘাতের সাথে সাথে প্রস্রবণ প্রবাহিত হয়ে পড়ল। এতে বুঝা গেল যে ইস্তেসকা, (পানির জন্য প্রার্থনা)- এর মূল হল দোয়া করা। এ দোয়া কোন কোন সময়ে ইস্তেসকার নামাজের আকারেও করা হয়েছে। যেমন এস্তেসকার নামাযের উদ্দেশ্যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঈদগাহতে তশরিফ নেওয়া এবং সেখানে নামাজ, খুতবা ও দোয়া করার কথা বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। আবার কখনো নামাজ বাদ দিয়ে শুধু বাহ্যিক অর্থে দোয়া করে ক্ষান্ত করেছেন। যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার খুতবায় পানির জন্য দোয়া করেন ফলে আল্লাহপাক বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
একথা সর্ব বিধিসম্মত যে, এস্তেসকা নামাজের আকারে হোক বা দোয়া রূপে হোক তাহা ক্রিয়াশীল ও গুরুত্ববহ হওয়ার জন্য পাপ থেকে তাওবা, নিজের দীনতা- হীনতা ও দাসত্ব সুলভ আচরণ এর অভিব্যক্তি একান্ত আবশ্যক। পাপে অটল এবং আল্লাহর অবাধ্যতায় অনড় থেকে দোয়া করলে তা ক্রিয়াশীল হবে বলে আশা করার অধিকার কারও নেই।
এ আয়াতের সংশ্লিষ্ট ঘটনা-
এ আয়াতের সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি 'তীহ' প্রান্তে সংঘটিত হয়েছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, বনি ইসরাইল রা যখন অত্যধিক পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে, তখন তারা হযরত মুসা আলাই সালাম এর নিকট পানির জন্য আবেদন করে। তখন হযরত মুসা আলাই সালাম এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করেন, ফলে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ক্যাসিও লাঠি দ্বারা পাথরের আঘাত করার নির্দেশ দেন। অতঃপর হযরত মুসা আলাইহিস সালাম উক্ত পাথরের আঘাত করার সাথে সাথে বারোটি প্রস্রবণ সৃষ্টি হয়। বনি ইসরাইলের বারোটি গোত্রের জন্য পৃথক পৃথক ঝরনা সৃষ্টি করা হয়। এটা মহান রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত শক্তির বহিঃপ্রকাশ। আর হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জীবন্ত মূজিজা বা অলোকিক ঘটনা। এরূপ ঘটনাকে মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা বলে। এরূপ ঘটনাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। পর্যটকদের মুখ থেকে শোনা যায় যে, এ পাথরটি এখনো 'সিনাই' উপদ্বীপে রয়েছে। পাথরের গায়ে এখনো প্রস্রবনের উৎস মুখের গর্ত গুলো পরিলক্ষিত হয়। (সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি)
চলবে....
Subscribe by Email
Follow Updates Articles from This Blog via Email
No Comments