সূরা আল বাকারা (আয়াত 41-45)অর্থ ও তাফসির
৪১. আর তোমরা সে গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, জামি অবর্তীর্ণ করেছি সত্য বক্তা হিসেবে তোমাদের কাছে।বস্তুতঃ তোমরা তার প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়োনা আর আমার আয়াতের অল্প মূল্য দিও না। এবং আমার (আজাব )থেকে বাঁচ।
৪২. তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না।
৪৩. আর নামাজ কায়েম কর, যাকাত দান করো এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়।
৪৪. তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভূলে যাও , অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করো? তবুও কি তোমরা চিন্তা করো না?
৪৫. ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা করো নামাজের মাধ্যমে ।অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন ।কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।
🌍 আল্লাহ সত্য বলেছেন।
👉উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা -
-----৪১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা---
🌱তোমরাই প্রথম এর অস্বীকারকারি হয়ো না।।
'অস্বীকার করা'প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল অবস্থায় অত্যন্ত বীভৎস। সব মানুষকে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে প্রথম দিকে যারা কুফরি করে, পরবর্তী লোকেরা তাদের অনুসরণ করে। এ কারণে প্রথম কুফরি কারীর অপরাধ সর্বাধিক বেশি।
সূরা আনকাবুত আল্লাহতালা বলেছেন-তারা অবশ্যই তাদের বোঝা সমূহ বহন করবে, বহন করবে তাদের বোঝার সাথে আরোও অনেক বোঝা।
🌱 আমার আয়াতের অল্প মূল্য দিও না।।
পার্থিব ও বস্তুগত স্বার্থের বিনিময়ে স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া এবং আখিরাতের চিরস্থায়ী নিয়ামতকে দুনিয়ার সামান্য মূল্যের বিনিময়ে ক্রয় করা। তবে এর অর্থ এ নয় যে, অধিক মূল্যে তা বিক্রয় করা যাবে। কেননা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও আখিরাতের মোকাবেলায় কিছু নয়।
👉--উক্ত আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে মাসাআলা-
ইসালে সওয়াব উপলক্ষে খতমে কোরআনের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ নেই:
পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মৃতদের ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরআন খতম করানো বা অন্য কোন কালাম ওজিফা পরানো হারাম। কারণে এর ওপর কোন ধর্মীয় মৌলিক প্রয়োজন নির্ভরশীল নয়।আর কুরআন শিক্ষাদান বা অনুরূপ অন্যান্য কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের যে অনুভূতি পরবর্তীকালে ফকীহগণ দিয়েছেন, তার কারণ এমন এক ধর্মীয় প্রয়োজন যে, তাতে বিচ্যুতি দেখা দিলে গোটা শরীয়তের বিধান ব্যবস্থার মূলে আঘাত আসবে। সুতরাং এই অনুমতি এসব বিশেষ প্রয়োজন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা আবশ্যক। এখন যেহেতু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোরআন পড়া হারাম। সুতরাং যে পড়বে এবং যে পড়াবে, তারা উভয়েই গুনাহগার হবে। বস্তুত পারিশ্রমিকের আশায় যে পড়ছে, সেই যখন কোন ছওয়াব পাচ্ছে না, তখন মৃত আত্মার প্রতি সে কি পৌঁছাবে?কবরের পাশে কুরআন পড়ানো বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খতম করানোর রীতি সাহাবী,তাবেঈ এবং প্রথম যুগের উম্মতের কোথাও বর্ণিত নেই। সুতরাং এগুলো নিঃসন্দেহে বিদআত।
👉কোরআন শিখিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ:
কুরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ কিনা? এ সম্পর্কে ফকিহগণের এর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।ইমাম মালেক ,শাফেয়ী, আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: জায়েজ বলে মত প্রকাশ করেছেন।কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির প্রমুখ কয়েকজন ইমাম তা নিষেধ করেছেন।কেননা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম কোরআনকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম পরিণত করতে বারন করেছে।
অবশ্য পরবর্তী হানাফী ইমামগণ বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে,পূর্বে কুরআনের শিক্ষকমন্ডলীর জীবন যাপনের ব্যাপারে ইসলামী বায়তুল মাল বা ইসলামী ধনভান্ডার থেকে নির্বাহ হত। কিন্তু বর্তমানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এ শিক্ষকমন্ডলী কিছুই লাভ করেন না। ফলে যদি তারা জীবিকার অন্বেষণে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেন, তবে ছেলেমেয়েদের কোরআন শিক্ষার ধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে।এজন্য কোরআন শিক্ষার বিনিময়ে প্রয়োজন হতে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েজ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।অনুরূপভাবে ইমামতি, আজান ,হাদীস ফিকহ শিক্ষাদানের প্রভৃতির যেসব কাজের উপর দ্বীন ও শরীয়তের স্থায়িত্ব অস্তিত্ব নির্ভর করে,সেগুলোকেও কোরআন শিক্ষা দানের সাথে সংযুক্ত করে প্রয়োজনমতো এগুলোর বিনিময়ে বেতন গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
--৪২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা--
🌱 তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না।।
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শ্রোতা ও সম্বোধিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ।অনুরূপভাবে কোন ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে সত্য গোপন করাও হারাম।
--৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা--
🌱 তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও..।।
কুরআনে কারীমে যতবার নামাজের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সাধারণত ইকামাত শব্দের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে, নামাজ পড়ার কথা শুধু দু এক জায়গায় বলা হয়েছে। এজন্যই ইকামাতিস সলাহ -এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। শাব্দিক অর্থ সোজা করা ,স্থায়ী করা। সাধারণত যেসব খুঁটি কোন দেওয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এজন্য ইকামাত স্থায়ী ও স্থিতিশীল অর্থে ব্যবহৃত হয়।
আভিধানিকভাবে যাকাতের অর্থ দু'রকম- পবিত্র করা বর্ধিত করা। শরীয়তের নির্দেশানুসারে সম্পদ থেকে যাকাত বের করা হয় এবং শরীয়ত মোতাবেক খরচ করা হয়।
যদি এখানে সমসাময়িক বনি ইসরাইলদের সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু তাতে কথা প্রমাণিত হয় না যে, নামায ও যাকাত ইসলাম পূর্ববর্তী বনি ইসরাইলদের উপর ফরজ ছিল। কিন্তু সূরা মায়েদার আয়াত এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নামাজ ও জাকাত ইসলাম পূর্ববর্তী বনি ইসরাইলদের উপর ফরজ ছিল। অবশ্য তার রূপ ও প্রকৃতি ছিল ভিন্ন।
নামাজের জামাত সম্পর্কিত নির্দেশাবলী-
নামাজের হুকুম এবং তা ফরজ হওয়া তো 'নামাজ কায়েম করো' শব্দের দ্বারাই বোঝা গেল। আয়াতে 'রুকুকারীদের সাথে' অর্থের দ্বারা নামাজ জামাতের সাথে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ হুকুমটি কোন ধরনের?
এ ব্যাপারে ওলামা ও ফকির গণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা:) এবং তাদের মধ্যে একদল জামাতকে
ওয়াজেব বলেছেন।এবং তা পরিত্যাগ করা কে কঠিন পাপ বলে অভিহিত করেছেন।কোন কোন সাহাবা(রা:) তো শরীয়ত সম্মত ওজর ব্যতীত জামাত হীন নামাজ জায়েজ নয় বলে মন্তব্য করেছেন, যারা জামাত ওয়াজিব এর প্রবক্তা এই আয়াতটি তাদের দলিল।
অধিকাংশ ওলামা, ফুকাহা, সাহাবা ও তাবেয়ীদের মতামত হল জামাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা।ফজরের সুন্নত এর ন্যায় সর্বাধিক তাগিদ পূর্ণ সুন্নত।ওয়াজিবের একেবারে নিকটবর্তী।
।আল্লাহ আপনাদেরকে সাথে আমাকে ও আমার পরিবারকে উত্তম প্রতিদান দান করুন ।।
👉চলবে..
Subscribe by Email
Follow Updates Articles from This Blog via Email
No Comments